সুহানা রহমান সুকন্যা
দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী, বীর শ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ
আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়নপ্রাপ্ত
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা
মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে এখনো মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যাপক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। শারীরিক অসুস্থতা হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই, কিন্তু মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসার কথা ভাবতেই লজ্জা বোধ করেন। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দিন দিন বাড়ছে এবং সমাজে আত্মহত্যা, বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের মতো জটিল সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই অবস্থার উত্তরণে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের সমাজে এখনো মানসিক সমস্যাকে তুচ্ছজ্ঞান করা হয়, অনেকেই মনে করেন যে এটি কোনো গুরুতর সমস্যা নয়। ফলে কিশোর-কিশোরীরা মানসিক চাপে ভুগলেও তারা কারো সাথে কথা বলতে পারেন না এবং নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মোকাবিলা করতে বাধ্য হন। এই চাপে অনেকেই হতাশ হয়ে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশে, বিশেষ করে তরুণ ও কিশোর বয়সীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ও আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান। তাই, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় ব্যক্তির মনের সুস্থতা, যার উপর ভিত্তি করে তার আবেগ, চিন্তা-ভাবনা এবং দৈনন্দিন আচরণ নির্ভর করে। এটি আমাদের প্রতিদিনের সম্পর্ক, কর্মস্থল এবং পড়াশোনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদি কেউ মানসিক চাপ বা অবসাদের শিকার হন, তবে তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। মানসিক সমস্যা ঠিকমতো বোঝা না হলে তা শারীরিক অসুস্থতার কারণও হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় ধরনের সমস্যা যা বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। কিশোর-কিশোরীরা মানসিক চাপে বেশি ভোগে, কারণ তাদের মনের ওপর পড়াশোনা, পারিবারিক চাপ, এবং সমাজের বিভিন্ন প্রত্যাশা ভার হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় পরিবার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আলোচনা না থাকায়, এই বিষয়গুলো সহজে তাদের মন থেকে বের হয় না। ফলে, সমস্যাগুলো তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে এবং অবশেষে এটি মানসিক সমস্যার রূপ নেয়।
এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা অপরিহার্য। পরিবারের সদস্যদের উচিত শিশুদের সাথে নিয়মিত কথা বলা, তাদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করা এবং সেগুলোর সমাধানে সাহায্য করা। স্কুল ও কলেজেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করা দরকার। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে হবে যে মানসিক সমস্যার কারণে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, বরং এর যথাযথ সমাধান জরুরি।
“টক হোপ” একটি অন্যতম সচেতনতামূলক উদ্যোগ যা মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। এই প্ল্যাটফর্মটি মূলত মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে মানুষ তাদের আবেগ ও অনুভূতিগুলো অবাধে শেয়ার করতে পারে এবং পেশাদার পরামর্শ ও সাহায্য পায়। টক হোপের উদ্দেশ্য হলো আত্মহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখা এবং হতাশাগ্রস্ত মানুষদের মানসিকভাবে সমর্থন যোগানো।
সামাজিকভাবে এই ধরনের প্ল্যাটফর্মকে সমর্থন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানসিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কিশোর ও তরুণরা বুঝতে পারে যে তারা একা নয় এবং প্রয়োজনে সাহায্যের জন্য আরও অনেকের দ্বারস্থ হতে পারে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক, যেখানে মানসিক সমস্যার ব্যাপারে সহানুভূতির সঙ্গে সমাধান দেওয়া হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা একটি সুখী, নিরাপদ এবং সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারি। আমাদের সমাজে এখনও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে এবং আমরা সবাই মিলেই যদি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি, তবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে মানসিক সুস্থতার একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব।